হজের সুবাসিত সুরভি
ক্যাটাগরিসমূহ
Full Description
হজের সুবাসিত সুরভি
نفحات الحج
<بنغالي>
শাইখ ড. সালেহ ইবন মুহাম্মদ আলে তালেব
الشيخ د. صالح آل طالب
অনুবাদক: আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
ترجمة: علي حسن طيب
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا
হজের সুবাসিত সুরভি
মসজিদে হারাম এখন হাজীদের অগ্রবর্তী দল ও দয়াময় আল্লাহর প্রতিনিধিদের স্বাগত জানাচ্ছে। মক্কা-মদীনা এখন এর অভিমুখীদের জন্য সুসজ্জিত হচ্ছে। হজের বাতাস বইতে শুরু করেছে। মোবারক দিনগুলোর আগমন ঘটেছে। হ্যা, এরা হাজী এবং যারা এখনো নিজেদের দেশ থেকে হজের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন তারাও। আগ্রহরা তাদের তাড়িত করছে এবং প্রাচীন-গৃহ-আলিঙ্গনের স্বপ্নগুলো তাদের তাড়া করছে। অনুভূতিগুলো পবিত্র ভূমির দিকে হৃদয়কে ধাবিত করছে, অন্তর ভরে দিচ্ছে ব্যথায় যা আত্মাকে বিদ্ধ করছে এবং কলবকে বদ্ধ করছে। তৈরি করছে আশা ও আশঙ্কা, প্রত্যাশার অনিশ্চয়তা এবং আগ্রহ ও আকর্ষণের ভালোবাসার মিশ্র আবেগ।
আল্লাহর সম্মানিত ঘর সফরের সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকেই হৃদয়-মন আবেগ-ব্যথায় আন্দোলিত হচ্ছে। ভাস্কর হয়ে উঠছে মক্কা ও এর পবিত্র স্থানগুলো। মদীনা ও এর নূরানী জায়গাগুলো। ভাবনা ছুটছে সুদূর অতীতে। দৃশ্যমান হয়ে উঠছে কুরাইশ ও তাদের নিদর্শনাবলি এবং প্রথম দাওয়াত ও এর তাৎপর্যগুলো। জায়গাগুলোর স্মৃতিচারণ শান্ত হৃদয়কে করে তরঙ্গায়িত। সুপ্ত বাসনাগুলোকে করে উদ্দীপ্ত। আর এসবের স্মৃতিচারণই সংশ্লিষ্ট স্মৃতি ও ঘটনাবলির প্রতীক।
কা‘বা ও পবিত্র হারাম, হেরা, যমযম ও মাকামে ইবরাহীম, গারে ছাওর ও খাইফু মিনা, ‘আরাফা উপত্যকা, মসজিদ নামিরা, বাতনে সাফা, দারুল আরকাম, মাশ‘আরে হারাম, শামা ও তাফিল, মুযদালিফা ও ছাবীর, হাররা ওয়াকিম, বনূ সালেম ইবন ‘আউফ, মসজিদে কুবা, আরিছ কূপ, উহুদ পাহাড়, বাকি‘, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস সালামের ঘর ও তাঁর মিম্বরের মধ্যস্থিত রওযা এবং খন্দকের নিদর্শনাবলি ও প্রভৃতি- মক্কা ও মদীনার এসব নামের প্রতিটিই আপনার হৃদয়ের কর্তৃত্ব নিয়ে নেয় যখনই নামগুলো স্মরণ করেন। যখনই আপনার চিত্ত এসবের পরিদর্শন ও দর্শন কামনা করে। যখনই আপনি এসব স্থানে ঘটে যাওয়া মহান মহান ঘটনা কল্পনা করেন। তখন গোপন কান্নারা ভিড় করে। আনন্দের অনুভূতির উষ্ণতা প্লাবিত হয়। ইসলামের জীবন্ত ইতিহাসের পর্যটন অন্যমনস্ক করে। কী সেই মহামুহূর্তগুলো? কী সেই মানবতার মর্যাদা বাড়ানো বিজয়ের দৃশ্যগুলো?
হজের বাতাস বইতে শুরু করেছে। মোবারক দিনগুলোর আগমন ঘটেছে। স্মরণ করা যাক সেদিনের কথা যখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস সালাম মানুষের কাছে হজের ঘোষণা দেন। ফলে লোকজন আসতে থাকে প্রত্যেক টিলা থেকে ও প্রত্যেক দিক থেকে। গ্রামাঞ্চল থেকে ও নির্জন প্রান্তর থেকে। সমতল থেকে ও পাহাড় থেকে। উপত্যকা থেকে ও মরুভূমি থেকে। পদব্রজে ও যানবাহনে। আল্লাহর পবিত্র ঘরের সাক্ষাতের অকৃত্রিম বাসনা তাদের উদ্দীপ্ত ও অস্থির করে।
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস সালাম লোকজন নিয়ে ২৫ যিলকদ শনিবার বাদ যোহর বের হন। তখন তাঁকে কেন্দ্র করে সমবেত হয় লক্ষাধিক হাজী। জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সেই ভীতিজাগানিয়া উপস্থিতির বিবরণ দিয়েছেন:
«فَصَلَّى رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْمَسْجِدِ، ثُمَّ رَكِبَ الْقَصْوَاءَ، حَتَّى إِذَا اسْتَوَتْ بِهِ نَاقَتُهُ عَلَى الْبَيْدَاءِ، نَظَرْتُ إِلَى مَدِّ بَصَرِي بَيْنَ يَدَيْهِ، مِنْ رَاكِبٍ وَمَاشٍ، وَعَنْ يَمِينِهِ مِثْلَ ذَلِكَ، وَعَنْ يَسَارِهِ مِثْلَ ذَلِكَ، وَمِنْ خَلْفِهِ مِثْلَ ذَلِكَ، وَرَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَيْنَ أَظْهُرِنَا»
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস সালাম মসজিদে নামাজ পড়লেন। অতপর কাসওয়ায় (উটের নাম) আরোহণ করলেন। তারপর যখন মরুপ্রান্তরে তাঁর উটনী গিয়ে উপনীত হলো, আমি দৃষ্টির দিগন্তে নজর প্রসারিত করলাম। তাঁর সামনে আরোহী ও পদব্রজী, তাঁর ডানেও তেমন, বামেও তেমন এবং পেছনেও তেমনি। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস সালাম আমাদের মাঝে...।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২১৮)
এ মহা উপস্থিতি যেন মহান আল্লাহর বাণীরই ভাষান্তর:
﴿هُوَ ٱلَّذِيٓ أَيَّدَكَ بِنَصۡرِهِۦ وَبِٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٦٢﴾ [الانفال: ٦٢]
‘তিনিই তোমাকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর সাহায্য ও মুমিনদের দ্বারা।’ {সূরা আল-আনফাল, আয়াত : ৬২)
আর হিজরতের আগের সেই দিনের কথা মনে করিয়ে দেয় যখন তিনি বিভিন্ন গোত্রের কাছে ঘুরে ফিরছিলেন এ কথা বলে,
«مَنْ يُؤْوِينِي؟ مَنْ يَنْصُرُنِي حَتَّى أُبَلِّغَ رِسَالَةَ رَبِّي، وَلَهُ الْجَنَّةُ؟»
“কে আমাকে আশ্রয় দেবে, কে আমাকে সাহায্য করবে আমি যাতে আমার রবের রিসালত পৌঁছাতে পারি, তার বিনিময় হবে জান্নাত?!” (মুসনাদ আমহদ, হাদীস নং: ১৪৪৫৬]
তখন তিনি নিজ দাওয়াতে কোনো সাড়াদাতা খুঁজে পান নি, পাশে কোনো সাহায্যকারী খুঁজে পান নি। কিন্তু আজ তারা তাঁর কাছে ছুটে এসেছে প্রতিটি প্রান্ত থেকে। স্মরণ করিয়ে দেয় সে দিনের কথা যখন তিনি মক্কা থেকে হিজরত করে বিতাড়িত হয়ে বেরিয়ে যান। তখন তাঁর সঙ্গে আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ছাড়া আর কেউ ছিল না। আর আজ দৃষ্টিসীমা অবধি লোকে লোকারণ্য। লোকে তাঁকে ঘিরে আছে এবং তাঁর উটের রেকাবিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি কত সত্য দেখুন,
﴿وَكَانَ حَقًّا عَلَيۡنَا نَصۡرُ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٤٧﴾ [الروم: ٤٧]
“আর মুমিনদেরকে সাহায্য করা তো আমার কর্তব্য।” [সূরা আর-রূম, আয়াত: ৪৭]
এটাই আল্লাহর রীতি, এটাই সেই চিহ্ন যা দেখে রাসূলদের অনুসারীরা পথ চলবে, যখনই দুষ্টরা বেড়ে যাবে কিংবা তাদের জন্য পথ সংকুচিত হবে।
হজের বাতাস বইতে শুরু করেছে। মোবারক দিনগুলোর আগমন ঘটেছে। আমরা যেন এখন বিদায় হজে প্রদত্ত নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস সালামের শাশ্বত খুৎবা শুনতে পাচ্ছি। যে খুৎবায় তিনি উম্মতের উদ্দেশে কিয়ামত পর্যন্তের জন্য সত্য কথা ও আসমানি বার্তা তুলে ধরেছিলেন, যার পরে আর কখনো তা নাযিল হবে না। সেদিন তিনি যা সাহাবীদের জন্য, আমাদের জন্য এবং আমাদের পরবর্তীদের জন্য বলেছিলেন তার মধ্যে ছিল,
«إن دماءَكم وأموالَكم عليكم حرام، فلا ترجِعوا بعدي كفارًا يضرِبُ بعضُكم رِقابَ بعضٍ، وإن رِبا الجاهليَّة موضوع، وقضَى الله أنه لا رِبا، واستَوصُوا بالنساء خيرًا؛ إن لنسائِكم عليكم حقًّا، ولكم عليهنَّ حقٌّ. إن ربَّكم واحد، وإن إلهَكم واحد، كلُّكم لآدم، وآدمُ من تُراب، ﴿إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ﴾ [الحجرات: ١٣]
“নিশ্চয় তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ হারাম ঘোষণা করা হচ্ছে। অতএব আমার পর তোমরা কুফরী অবস্থায় ফিরে গিয়ে একে অপরের ঘাড়ে আঘাত করবে না। আর জাহেলী যুগের সুদ রহিত করা হলো। আল্লাহর চূড়ান্ত ফয়সালা হলো কোনো সুদ থাকবে না। আর তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। তোমাদের ওপর স্ত্রীদের অধিকার রয়েছে, তেমনি তোমাদেরও অধিকার রয়েছে স্ত্রীদের ওপর। তোমাদের সবার রব এক। তোমাদের ইলাহ এক। তোমরা প্রত্যেকেই আদম থেকে আর আদম মাটি থেকে তৈরি। “তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন।” [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩]
এ ছিলো আল্লাহর নবীর বাক্যমালা। যেখানে ঘোষিত হয়েছে ইনসাফ ও কল্যাণের মর্মবাণী। এতে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে আকীদা, একতা, রক্তপাত, সম্পদ, স্ত্রী, মানবতা ইত্যাদি প্রসঙ্গ।
হজের বাতাস বইতে শুরু করেছে। মোবারক দিনগুলোর আগমন ঘটেছে। হজে যেন আমরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছন পেছন চলছি। হজের প্রতিটি অবস্থানে তিনি ঘোষণা দিচ্ছেন, তাঁর হজপ্রণালী ও হজপদ্ধতি পৌত্তলিকদের হজ এবং কাফেরদের প্রণালীর বিপরীত। তিনি তাদের চেয়ে স্বতন্ত্র এবং তাদের পথ-পন্থা থেকে দূরে। মুশরিকরা সূর্যোদয়ের আগে (তাওয়াফের জন্য কা‘বায়) মুযদালিফা থেকে ফিরে আসত। তাদের বিপরীতে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্যোদয়ের আগেই প্রত্যাবর্তন করেছেন। তিনি বলেন,
«خالفَ هديُنا هديَ المُشركين»
“আমাদের আদর্শ মুশরিকদের আদর্শ থেকে ভিন্ন।” (মুসনাদ আহমদ)
তাঁর অভিপ্রায় হলো, তাঁর উম্মত যেন নিজ আদর্শে স্বতন্ত্র হয়। সে প্রাচ্যের অন্ধ অনুকরণ করবে না। অনুসরণ করবে না পশ্চিমের। তাদের নিদর্শনগুলোকে নিজেদের নিদর্শনের সঙ্গে একাকার করবে না। তাদের আদর্শকে নিজেদের আদর্শ থেকে অগ্রাধিকার দেবে না।
তিনি এ মর্মে মানুষকে সচেতন করছেন যে এ উম্মতই পূর্ববর্তী নবীগণের উত্তরসূরী। আর এ উম্মতই এ উত্তরাধিকার সর্বদা ধরে রাখবে। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসফান উপত্যকা অতিক্রমকালে জিজ্ঞেস করেন, ‘হে আবূ বকর, এটি কোন উপত্যকা?’ তিনি বলেন, উসফান উপত্যকা। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لقد مرَّ به هودٌ وصالِحٌ على بَكرَين أحمرَين، خُطمُهما اللِّيف، وأُزُرُهم العباء، وأرضيتُهم النِّمار، يُلبُّون يحُجُّون البيتَ العتيق»
“এটি অতিক্রম করেছেন হূদ ও সালেহ দুটি লাল বাহনে করে। যাদের শুঢ় আঁশের, গদি পশমের, তাদের গায়ের চাদর ছিল ‘আবা’, তাঁরা বাইতুল আতীক তথা কা‘বা ঘরের হজ করছেন এবং তালবিয়া পাঠ করছেন।” (মুসনাদ আহমাদ)
এ ঘরের হজ করেছেন মূসা ইবন ইমরান ও ইউনুস ইবন মাত্তা ‘আলাইহিমাস সালাম। আর শেষ যুগে এর হজ করবেন ঈসা ‘আলাইহিস সালাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَيُهِلَّنَّ ابْنُ مَرْيَمَ بِفَجِّ الرَّوْحَاءِ، حَاجًّا أَوْ مُعْتَمِرًا، أَوْ لَيَثْنِيَنَّهُمَا»
“শপথ ওই সত্তার যার হাতে আমার প্রাণ, মারইয়ামের ছেলে (ঈসা) ফাজ্জে রাওহায় উঁচু স্বরে তালবীয়া পাঠ করবেন হাজী বা উমরাকারী কিংবা উভয়টা হিসেবে।” (সহীহ মুসলিম)
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ উম্মতকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, যখন সে আল্লাহর সম্মানিত ঘরে যাত্রা করে সে মূলত সংশ্লিষ্ট নবীদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে। সে তার শিকড়ের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক সুদৃঢ় করে। হজে এ উম্মত নবী, সিদ্দীক ও শহীদদের পথেরই অনুগমন করে আল্লাহ যাদের পুরস্কৃত করেছিলেন। এ যাত্রা তো নবীদের পদচিহ্নেই চলছে:
﴿ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ هَدَى ٱللَّهُۖ فَبِهُدَىٰهُمُ ٱقۡتَدِهۡۗ ﴾ [الانعام: ٩٠]
“এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ হিদায়াত করেছেন। অতএব তাদের হিদায়াত তুমি অনুসরণ কর।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৯০]
কুরআন এদিকে আল্লাহ তা‘আলার বাণীর মাধ্যমেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে:
﴿وَٱتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبۡرَٰهِۧمَ مُصَلّٗىۖ ﴾ [البقرة: ١٢٥]
“এবং (আদেশ দিলাম যে,) ‘তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থানরূপে গ্রহণ কর।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২৫]
হজ করা হয় সকল নিষ্ঠাবানের নেতা ও নবীদের পিতা ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের ডাক এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আহ্বানে সাড়া দিয়ে। ওইসব জায়গা দেখবেন আর আপনার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠবে:
﴿وَإِذۡ يَرۡفَعُ إِبۡرَٰهِۧمُ ٱلۡقَوَاعِدَ مِنَ ٱلۡبَيۡتِ وَإِسۡمَٰعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّآۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ١٢٧ رَبَّنَا وَٱجۡعَلۡنَا مُسۡلِمَيۡنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَآ أُمَّةٗ مُّسۡلِمَةٗ لَّكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبۡ عَلَيۡنَآۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ١٢٨ رَبَّنَا وَٱبۡعَثۡ فِيهِمۡ رَسُولٗا مِّنۡهُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَيُزَكِّيهِمۡۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ١٢٩﴾ [البقرة: ١٢٧، ١٢٩]
“আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল কাবার ভিতগুলো উঠাচ্ছিল (এবং বলছিল,) ‘হে আমাদের রব, আমাদের পক্ষ থেকে কবূল করুন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী। হে আমাদের রব, আমাদেরকে আপনার অনুগত করুন এবং আমাদের বংশধরের মধ্য থেকে আপনার অনুগত কওম বানান। আর আমাদেরকে আমাদের ইবাদাতের বিধি-বিধান দেখিয়ে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। হে আমাদের রব, তাদের মধ্যে তাদের থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যে তাদের প্রতি আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবে আর তাদেরকে পবিত্র করবে। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২৭-২২৯]
এদিকে বিদায় হজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের উদ্দেশে বলেছেন,
«قِفُوا عَلَى مَشَاعِرِكُمْ، فَإِنَّكُمْ عَلَى إِرْثٍ مِنْ إِرْثِ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ»
“তোমাদের হজের নিদর্শনপূর্ণ স্থানসমূহে অবস্থান করো, কারণ তোমরা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের উত্তরাধিকারের ওপর রয়েছে।” (সুনান চতুষ্টয়)
আল্লাহ বলেছেন,
﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗاۚ ﴾ [المائدة: ٣]
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নি‘আমত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দীন হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে।” [সূরা আল-মায়িদাহ, আয়াত: ৩]
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও সতর্ক করছেন,
«خُذُوا مَنَاسِكَكُمْ لِعَلِّي لَا أَلْقَاكُمْ بَعْدَ عَامِي هَذَا »
“আমার কাছ যেন হজের বিধান শিখে নেয়। কারণ আমি জানি না, এ বছরের পর সম্ভবত তাদের সাথে আমার আর সাক্ষাত হবে না।”
হজের বাতাস বইতে শুরু করেছে। মোবারক দিনগুলোর আগমন ঘটেছে। দয়াময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে অন্তর ছুটছে মহা ফযীলতের সাফল্যের দিকে এবং সম্মানিত ঘর অভিমুখে। আল্লাহর বাণী :
﴿ وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَيۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَيۡهِ سَبِيلٗاۚ ﴾ [ال عمران: ٩٧]
“সামর্থ্যবান মানুষের উপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ করা ফরয।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭]
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী:
«أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ فَرَضَ اللهُ عَلَيْكُمُ الْحَجَّ، فَحُجُّوا»
“হে লোক সকল, তোমাদের ওপর আল্লাহ হজ ফরয করেছেন। অতএব তোমরা হজ করো।” (সহীহ মুসলিম)
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ حَجَّ لِلَّهِ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ».
‘যে আল্লাহর জন্য হজ করল, যৌন-স্পর্শ রয়েছে এমন কাজ ও কথা থেকে বিরত থাকল এবং শরীয়ত অনুমতি দেয় না এমন কাজ থেকে বিরত থাকল, সে তার মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনের মতো পবিত্র হয়ে ফিরে এল।” (সহীহ বুখারী হাদীস নং ১৫২১, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩৫০)
একই সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا والحجُّ المبرورُ ليس له جزاءٌ إلا الجنة».
“এক উমরা থেকে অন্য উমরা -এ দুয়ের মাঝে যা কিছু (পাপ) ঘটবে তা তার জন্য কাফফারা। আর মাবরুর হজের একমাত্র প্রতিদান হলো জান্নাত। (বুখারী ও মুসলিম)
আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«تَابِعُوا بَيْنَ الحَجِّ وَالعُمْرَةِ، فَإِنَّهُمَا يَنْفِيَانِ الفَقْرَ وَالذُّنُوبَ كَمَا يَنْفِي الكِيرُ خَبَثَ الحَدِيدِ، وَالذَّهَبِ، وَالفِضَّةِ، وَلَيْسَ لِلْحَجَّةِ المَبْرُورَةِ ثَوَابٌ إِلَّا الجَنَّةُ».
“তোমরা হজ ও উমরা পরপর করতে থাক, কেননা তা অভাব ও গুনাহ দূর করে দেয়, যেমন দূর করে দেয় কামারের হাপর লোহা, সোনা ও রুপার ময়লাকে। আর মাবরূর হজের একমাত্র প্রতিদান জান্নাত।” (জামে তিরমিযী)
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল,
«أَيُّ العَمَلِ أَفْضَلُ؟ فَقَالَ: «إِيمَانٌ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ». قِيلَ: ثُمَّ مَاذَا؟ قَالَ: «الجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ» قِيلَ: ثُمَّ مَاذَا؟ قَالَ: «حَجٌّ مَبْرُورٌ»
“কোন আমলটি সর্বোত্তম? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান। বলা হলো, তারপর কী? তিনি বললেন, ‘আল্লাহর পথে জিহাদ করা। বলা হলো তারপর কোনটি? তিনি বললেন, কবুল হজ।” (বুখারী ও মুসলিম)
হজে গুনাহ মাফ এবং অপরাধ মিটে যায়। আর দো‘আ কবুল করা হয় এবং বহুগুণ প্রতিদান দেওয়া হয়। হজের মধ্যে আরাফা দিবসের রয়েছে আবার বিশেষ তাৎপর্য। সেটিই সে দিন যার সাক্ষ্য দেওয়া হবে। যার শপথ করেছেন আল্লাহ তাঁর বাণীতে:
﴿وَٱلسَّمَآءِ ذَاتِ ٱلۡبُرُوجِ ١ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡمَوۡعُودِ ٢ وَشَاهِدٖ وَمَشۡهُودٖ ٣﴾ [البروج: ١، ٣]
“কক্ষপথ বিশিষ্ট আসমানের কসম, আর ওয়াদাকৃত দিনের কসম, আর কসম সাক্ষ্যদাতার এবং যার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেওয়া হবে তার।” [সূরা আল-বুরূজ, আয়াত: ১-৩]
আয়াতে ওয়াদাকৃত দিন বলে কিয়ামত দিবস, যার সাক্ষ্য দেওয়া হবে বলে ‘আরাফা দিবস এবং সাক্ষ্যদাতা হবে জুমু‘আর দিনকে বুঝানো হয়েছে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا مِنْ يَوْمٍ أَكْثَرَ مِنْ أَنْ يُعْتِقَ اللهُ فِيهِ عَبْدًا مِنَ النَّارِ، مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ، وَإِنَّهُ لَيَدْنُو، ثُمَّ يُبَاهِي بِهِمِ الْمَلَائِكَةَ، فَيَقُولُ: مَا أَرَادَ هَؤُلَاءِ؟»
“আরাফার মতো কোনো দিন নেই যাতে আল্লাহ বেশি বান্দাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেন। আল্লাহ সেদিন নিকটবর্তী হন এবং এদের নিয়ে ফিরিশতাদের সঙ্গে গর্ব করে বলেন, ওরা কী চায়?” (সহীহ মুসলিম)
তিনি আরও বলেছেন,
«صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ، وَالسَّنَةَ الَّتِي بَعْدَهُ»
“আরাফা দিবসের সিয়াম সম্পর্কে আল্লাহর কাছে ধারণা রাখি তিনি পূর্বের এক বছর এবং পরের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।” (সহীহ মুসলিম)
শুধু ‘আরাফা দিবস কেন হজের পুরোটাই বিবিধ কল্যাণে টইটুম্বর। দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণে ভরপুর এ হজ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَأَذِّن فِي ٱلنَّاسِ بِٱلۡحَجِّ يَأۡتُوكَ رِجَالٗا وَعَلَىٰ كُلِّ ضَامِرٖ يَأۡتِينَ مِن كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٖ ٢٧ لِّيَشۡهَدُواْ مَنَٰفِعَ لَهُمۡ وَيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ فِيٓ أَيَّامٖ مَّعۡلُومَٰتٍ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلۡأَنۡعَٰمِۖ فَكُلُواْ مِنۡهَا وَأَطۡعِمُواْ ٱلۡبَآئِسَ ٱلۡفَقِيرَ ٢٨﴾ [الحج: ٢٧، ٢٨]
“আর মানুষের মাঝে হজের ঘোষণা দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং কৃশকায় উটে চড়ে দূর পথ পাড়ি দিয়ে। যেন তারা নিজদের কল্যাণের স্থানসমূহে হাযির হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু থেকে যে রিযিক দিয়েছেন তার ওপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে। অতঃপর তোমরা তা থেকে খাও এবং দুস্থ-দরিদ্রকে খেতে দাও।” [সূরা আল-হজ, আয়াত: ২৭-২৮]
অতএব, হে মুসলিম ভাইয়েরা, অবিলম্বে হজে আসুন। কারণ, আমরা কেউ জানি না আগামীতে আমার কী হবে? আল্লাহ আমাদের সকলকে মুসলিমকে হজের তাওফীক দান করুন। আমীন।
সমাপ্ত