×
জনৈক নাস্তিকের প্রশ্ন: “কেন আল্লাহ আদম সৃষ্টির দীর্ঘ বিরতির পর হাওয়াকে সৃষ্টি করেছেন, অথচ তিনি জানতেন আদমের সঙ্গীর প্রয়োজন আছে? যদি তিনি সবকিছু জানেন, তাহলে কেন তাদের দু’জনকে একসঙ্গে সৃষ্টি করেননি”? অত্র ফতোয়ায় তার উত্তর প্রদান করা হয়েছে।

    সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

    প্রশ্ন: আমি জনৈক নাস্তিকের সাথে কথা বলছিলাম, সে আমাকে প্রশ্ন করে বলল: “আদম সৃষ্টির দীর্ঘ বিরতির পর কেন আল্লাহ হাওয়াকে সৃষ্টি করেছেন, অথচ তিনি জানতেন আদমের সঙ্গীর প্রয়োজন আছে? যদি তিনি সবকিছু জানেন, তাহলে কেন তাদের দু'জনকে একসঙ্গে সৃষ্টি করেন নি"? আমাকে জানিয়ে বাধিত করবেন, যেন তার উত্তর দিতে পারি।

    উত্তর: আল-হামদুলিল্লাহ।

    প্রথমত: আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে, আল্লাহ যা চান তাই করেন, তাকে জবাবদিহি করা যায় না, তবে বান্দাদেরকে জবাবদিহি করা হবে। বান্দার অধিকার নেই রবকে প্রশ্ন করা, 'কেন করেছেন'? ইমাম ইসহাক ইবন ইবরাহীম রহ. বলেন: “আল্লাহর কর্ম সম্পর্কে ঘাটাঘাটি করা যায় না, যেরূপ মানুষের কর্ম সম্পর্কে করা যায়। তিনি বলেন:

    ﴿لَا يُسَۡٔلُ عَمَّا يَفۡعَلُ وَهُمۡ يُسَۡٔلُونَ ٢٣﴾ [الانبياء: ٢٣]

    “তিনি যা করেন, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে না, বরং তাদেরকেই প্রশ্ন করা হবে।" [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২৩]

    আল্লাহর কোনো সিফাৎ ও কর্ম সম্পর্কে বিবেক দ্বারা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই, যেমন মানুষের স্বভাব ও কর্ম সম্পর্কে বিবেক দ্বারা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।"[1]

    এটা শুধু এ কারণে নয় যে, তিনি পরাক্রমশালী, যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন, বরং তার প্রতিটি কর্ম হিকমত, ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতায় ভরপুর। তিনি বলেন:

    ﴿أَلَا يَعۡلَمُ مَنۡ خَلَقَ وَهُوَ ٱللَّطِيفُ ٱلۡخَبِيرُ ١٤﴾ [الملك: ١٤]

    “যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি জানেন না? অথচ তিনি অতি সুক্ষ্মদর্শী, পূর্ণ অবহিত"[সূরা আল-মুলক, আয়াত: ১৪]

    দ্বিতীয়ত: আপনাকে প্রশ্নকারী নাস্তিক বলেছে, 'আদম সৃষ্টির দীর্ঘ বিরতির পর আল্লাহ তা'আলা হাওয়াকে সৃষ্টি করেছেন'! তাকে বলুন: এ তথ্য তুমি কোথায় পেয়েছ?! এটা অদৃশ্যের জ্ঞান, যা তুমি দেখ নি, তোমার ইতিহাসজ্ঞান ও তোমার মতো লোকদের ইতিহাস সে পর্যন্ত পৌঁছতে পারে নি। যদি নবীদের সংবাদ বিশ্বাস করে বলে থাক, তাহলে আল্লাহর বড়ত্ব, মহত্ত্ব ও একত্ববাদ সম্পর্কে তাদের সংবাদও বিশ্বাস কর, তারা যে অহী, অদৃশ্য জগত, জান্নাত ও জাহান্নাম সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন তাও বিশ্বাস কর। অতঃপর দেখ, যদি এ জাতীয় প্রশ্নের সুযোগ থাকে, তাহলে কর!!

    আমাদের নিকট এ জাতীয় প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই। কারণ, আমাদের দীনের মূলনীতি হচ্ছে সর্বতোভাবে নিজেকে আল্লাহর নিকট সোপর্দ করা। অধিকন্তু আমরা তোমাকে জানাচ্ছি যে, বাহ্যত আদম ও হাওয়ার সৃষ্টির মাঝে দীর্ঘ বিরতি ছিল না, তুমি যার দাবি করছ। বস্তুত আদমকে জান্নাতে প্রেরণ করার পূর্বেই আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন। আবু হুরায়রা সূত্রে ইমাম বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

    «اسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ فَإِنَّ الْمَرْأَةَ خُلِقَتْ مِنْ ضِلَعٍ وَإِنَّ أَعْوَجَ شَيْءٍ فِي الضِّلَعِ أَعْلَاهُ، فَإِنْ ذَهَبْتَ تُقِيمُهُ كَسَرْتَهُ، وَإِنْ تَرَكْتَهُ لَمْ يَزَلْ أَعْوَجَ فَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ»

    “তোমরা নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হও, কারণ নারীকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, পাঁজরের মধ্যে উপরের হাড্ডি সবচেয়ে বেশি বাঁকা। যদি তা সোজা করতে চাও ভেঙ্গে ফেলবে, ছেড়ে দিলে বাঁকাই থেকে যাবে। অতএব, নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী হও।"[2] হাফেয ইবন হাজার রহ. বলেন: “এ হাদীস ইবন ইসহাকও বর্ণনা করেছেন, তবে তিনি অতিরিক্ত বলেছেন:

    «الْيُسْرَى مِنْ قَبْل أَنْ يَدْخُل الْجَنَّة ، وَجُعِلَ مَكَانه لَحْم»

    “জান্নাতে প্রবেশ করানোর পূর্বে বাম পাঁজর থেকে (তাকে সৃষ্টি করা হয়), অতঃপর তার জায়গায় গোশত তৈরি করা হয়।"[3]

    ইবন কাসির রহ. বলেন: আল্লাহ তা'আলা আদম ও তার স্ত্রীকে জান্নাতে বসবাস করার নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি বলেন:

    ﴿وَقُلۡنَا يَٰٓـَٔادَمُ ٱسۡكُنۡ أَنتَ وَزَوۡجُكَ ٱلۡجَنَّةَ وَكُلَا مِنۡهَا رَغَدًا حَيۡثُ شِئۡتُمَا وَلَا تَقۡرَبَا هَٰذِهِ ٱلشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ ٱلظَّٰلِمِينَ ٣٥﴾ [البقرة: ٣٥]

    “আর আমরা বললাম, 'হে আদম, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং তা থেকে আহার কর স্বাচ্ছন্দ্যে, তোমাদের ইচ্ছানুযায়ী এবং এই গাছটির নিকটবর্তী হয়ো না, তাহলে তোমরা যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে"[সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৩৫]

    তিনি অন্যত্র বলেন:

    ﴿وَيَٰٓـَٔادَمُ ٱسۡكُنۡ أَنتَ وَزَوۡجُكَ ٱلۡجَنَّةَ فَكُلَا مِنۡ حَيۡثُ شِئۡتُمَا وَلَا تَقۡرَبَا هَٰذِهِ ٱلشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ ٱلظَّٰلِمِينَ ١٩﴾ [الاعراف: ١٩]

    “আর হে আদম, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বাস কর। অতঃপর তোমরা আহার কর যেখান থেকে চাও এবং এই গাছটির নিকটবর্তী হয়ো না। তাহলে তোমরা উভয়ে যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে"[সূরা আল-আ'রাফ, আয়াত: ১৯]

    অন্যত্র বলেন:

    ﴿وَإِذۡ قُلۡنَا لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ ٱسۡجُدُواْ لِأٓدَمَ فَسَجَدُوٓاْ إِلَّآ إِبۡلِيسَ أَبَىٰ ١١٦ فَقُلۡنَا يَٰٓـَٔادَمُ إِنَّ هَٰذَا عَدُوّٞ لَّكَ وَلِزَوۡجِكَ فَلَا يُخۡرِجَنَّكُمَا مِنَ ٱلۡجَنَّةِ فَتَشۡقَىٰٓ ١١٧ إِنَّ لَكَ أَلَّا تَجُوعَ فِيهَا وَلَا تَعۡرَىٰ ١١٨ وَأَنَّكَ لَا تَظۡمَؤُاْ فِيهَا وَلَا تَضۡحَىٰ ١١٩﴾ [طه: ١١٦، ١١٩]

    “আর স্মরণ কর, যখন আমরা ফিরিশতাদের বললাম, 'তোমরা আদমকে সাজদাহ কর', তখন ইবলীস ছাড়া সকলেই সাজদাহ করল; সে অমান্য করল। অতঃপর আমরা বললাম, 'হে আদম, নিশ্চয় এ তোমার ও তোমার স্ত্রীর শত্রু, সুতরাং সে যেন তোমাদের উভয়কে কিছুতেই জান্নাত থেকে বের করে না দেয়, তাহলে তোমরা দূর্ভোগ পোহাবে। নিশ্চয় তোমার জন্য এ ব্যবস্থা যে, তুমি সেখানে ক্ষুধার্তও হবে না এবং বস্ত্রহীনও হবে না। আর সেখানে তুমি পিপাসার্তও হবে না এবং রৌদ্রদগ্ধও হবে না"[সূরা ত্বহা, আয়াত: ১১৬-১১৯]

    এ আয়াতসমূহ থেকে বুঝে আসে যে, আদমের জান্নাতে প্রবেশের পূর্বেই হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয়েছে। ইবন ইসহাক যা স্পষ্ট বলেছেন। এটাই আয়াতের বাহ্যিক অর্থ।"[4]

    তৃতীয়ত: এও তো সম্ভব যে, এতে হিকমত রয়েছে, যার নাগাল তার বিবেক পায় নি, আমরাও যা হাসিল করতে পারি নি। মানুষের বিবেক কি মহা বিশ্বের সর্বত্র পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে, তার ভেতর ও বাহির সকল রহস্য উদ্ঘাটন করতে কি সক্ষম হয়েছে, হয় নি। বিজ্ঞান যা আবিষ্কার করতে পারে নি কিংবা যার বাস্তবতা ও রহস্য সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত জানা যায় নি, তার কি অস্তিত্ব নেই, সেখানে পৌঁছার প্রচেষ্টা অব্যাহত নেই?! অতএব, আদম ও হাওয়াকে একসঙ্গে সৃষ্টি না করার কারণ না-জানা আমাদের জন্য দোষণীয় নয়, অনুরূপ আমাদের না-জানা তাতে কোনো হিকমত নেই তারও প্রমাণ নয়।

    অতঃপর কে বলেছে আদমের শূণ্যতা অনুভব করায় ফায়দা নেই, যে শূণ্যতা দূর করা হয়েছে স্ত্রী হাওয়ার মাধ্যমে? দুঃখ পরবর্তী সুখ দীর্ঘ দিন স্মরণ থাকে, আদমও তার স্ত্রীর নি'আমত দীর্ঘ দিন স্মরণ রাখবে স্বাভাবিক, কৃতজ্ঞতা ভরে নিজেকে তার নিকট সঁপে দিবে। হয়তো এ শূণ্যতায় সে আল্লাহর নিকট নিজের প্রয়োজন পেশ করেছে, নিঃসঙ্গতার অভিযোগ করেছে ও একাকীত্ব দূর করার নিমিত্তে প্রার্থনা করেছে, আর এটাই তো উবুদিয়াত বা দাসত্ব, বান্দার নিকট আল্লাহ তা'আলা যা চান।

    সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যার প্রতিটি কর্ম পরিপূর্ণ হিকমত ও উপযুক্ত প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

    সূত্র: موقع الإسلام سؤال وجواب

    [1] আল-ইস্তিকামাহ: (১/৭৮) লি ইবন তাইমিয়্যাহ

    [2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৩৩১; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৪৭০

    [3] ফাতহুল বারি: (৬/৩৬৮)

    [4] বিদায়া ও নিহায়া: (১/৮১), সংক্ষিপ্ত করে নেওয়া।